ফজরের আজান শুরু হয়েছে, এমতাবস্থায় আপনার হাতে সেহরির খাবার; এখন কী করবেন?

ফজরের আজান শুরু হলে সেহরির খাবার নিয়ে করণীয়
প্রাবন্ধিক: ফাদ্বীলাতুশ শাইখ ‘আব্দুল ক্বাদির বিন মুহাম্মাদ আল-জুনাইদ (হাফিযাহুল্লাহ)
আরম্ভ করছি তাঁর নামে, যিনি পরম অনুগ্রহকারী ও করুণাময়। সমুদয় স্তুতি তাঁর জন্য নিবেদিত, যিনি বিশ্বজগতের মহান প্রতিপালক। শত-সহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, যিনি সমগ্র জাহানের জন্য অনুকম্পাস্বরূপ প্রেরিত দূত, আলোকবর্তিকা ও দিশারী। অতঃপর:
অনুবাদকের নিবেদন
ফতোয়াটি পড়েছিলাম একটি বহুল প্রচলিত মাসিক পত্রিকায়। রীতিমতো আমলও করতাম সেই ফতোয়া অনুযায়ী। কমসেকম বছর সাতেক তো হবেই, এর ওপর আমল করেছি। অবশ্য পরবর্তী যুগের কতিপয় ‘উলামার ফতোয়াও পেয়েছিলাম ওই ফতোয়ার স্বপক্ষে। কথা বলছি এই ফতোয়ার ব্যাপারে যে, সেহরিরত অবস্থায় আজান হয়ে গেলেও প্লেটের খাবার শেষ করা জায়েজ। প্রমাণস্বরূপ সুনানে আবূ দাঊদের একটি প্রসিদ্ধ হাদীস পেশ করা হয়, যেখানে এই হুকুম গ্রহণের সিদ্ধতা বিবৃত হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে ব্যাপারটা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। সাহাব ডট নেটের এক আর্টিকেলে মোটামুটি এই টাইপের কথা পড়েছিলাম যে, মক্কার এক 'আলিমকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘সেহরিরত অবস্থায় আজান হয়ে যাওয়ার পরেও আমি কিছু আহার্য বা পানীয় গ্রহণ করেছি, এতে কি আমার রোজা ভেঙে যাবে?’ তিনি উত্তরে বলেছেন, ‘ওই রোজা নষ্ট হয়ে গেছে, পরে রোজার কাজা আদায় করতে হবে।’
সে সময় কিংবা তারও পরে আমি আলোচ্য বিষয়ে ফাদ্বীলাতুশ শাইখ ‘আব্দুল ক্বাদির আল-জুনাইদ (হাফিযাহুল্লাহ)’র একটি নিবন্ধ পেয়ে যাই। নিবন্ধের আলোচনা আমাকে অভিভূত করে। ফলে আমি এ ব্যাপারে পোষণকৃত আমার পূর্বের ধারণাটি পরিবর্তন করি। আরবি নিবন্ধটির যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, তা অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়—“আপনার হাতে খাদ্য বা পানীয় রয়েছে, এমতাবস্থায় মুয়াজ্জিন যদি ফজর উদয় হওয়ার আজান দেয়, তথাপি আপনি পানাহার চালিয়ে যান, তাহলে চার মাযহাবের ‘উলামা এবং যাহিরী ও অন্যান্য বিদ্বানদের অধিকাংশের নিকট আপনার রোজা বাতিল হিসেবে পরিগণিত হবে।”
মূল নিবন্ধের বঙ্গানুবাদ
জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের সত্যভাষী বিশস্ত নাবী মুহাম্মাদের প্রতি এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর প্রতি। অতঃপর:
হে সম্মাননীয় মহৎ ব্যক্তিবর্গ, আল্লাহ আপনাদের সঠিক পথে রাখুন এবং আপনাদের ‘ইলম ও আমল বৃদ্ধি করুন। নিশ্চয় রোজার নিয়তকারী ব্যক্তির পানাহারের প্রান্তসীমা তখন উপনীত হয়, যখন মুয়াজ্জিন ফজর উদয়ের আজান আরম্ভ করে। যে ব্যক্তি রোজার নিয়ত করেছে, সে যখন মুয়াজ্জিনের উক্ত আজান শোনে, তখন পানাহার থেকে বিরত হওয়া এবং মুখগহ্বরে স্থিত আহার্য ও পানীয় মুখ থেকে ফেলে দেওয়া তার জন্য আবশ্যক (ওয়াজিব)। নচেৎ তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। এটা চার মাযহাবের ‘উলামা এবং যাহিরী ও অন্যান্য বিদ্বানদের অধিকাংশের অভিমত।
ভিন্ন মতাবলম্বীদের দলিলের পর্যালোচনা
পক্ষান্তরে একটি হাদীস রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, إِذَا سَمِعَ أَحَدُكُمُ النِّدَاءَ وَالإِنَاءُ عَلَى يَدِهِ فَلاَ يَضَعْهُ حَتَّى يَقْضِىَ حَاجَتَهُ مِنْهُ “তোমাদের কেউ যখন আজান শোনে, এমতাবস্থায় তার হাতে রয়েছে পানপাত্র, তখন সে যেন ওই পাত্র থেকে নিজের প্রয়োজন সম্পূর্ণ না করার আগে তা রেখে না দেয়।”
এই হাদীস দুই দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। যথা:
- সনদের দিক থেকে। কেননা হাম্মাদ বিন সালামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক হাদীসটির মাওকূফ, মারফূ‘, মুরসাল ও মাক্বতূ‘ বর্ণনায় মতভেদ রয়েছে।
- মতন বা মূল টেক্সটের দিক থেকে (হাদীসটি ত্রুটিপূর্ণ)। কেননা উক্ত হাদীস সূরাহ বাক্বারাহর সুস্পষ্ট আয়াতের বিরোধী এবং তার চেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের পরিপন্থি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
আমি পূর্বে বলেছি, ‘আমি এই পর্যন্ত প্রাক-পূর্ববর্তী আইম্মায়ে হাদীসের কোনো একজনেরও বক্তব্য পাইনি, উক্ত হাদীসকে বিশুদ্ধ আখ্যানের ব্যাপারে।’ আবূ ‘আব্দুল্লাহ হাকিম (রাহিমাহুল্লাহ) তদীয় ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহিহ বলার দরুন আমার পূর্বোক্ত কথার ব্যাপারে যেন আপত্তি তোলা না হয়। তাই আমি বলছি, এটা এমন একজনের পক্ষ থেকে সহিহ সাব্যস্তকরণ, যিনি হলেন পরবর্তী মুহাদ্দিস এবং সহিহ বলার ক্ষেত্রে শৈথিল্যবাদী।